পাঠক, অনেকেই আছেন যারা ভালো মতো বুঝেন না যে ‘চার্টার্ড বিমান’ আসলে কেমন বিমান বা বিষয়টি কি? যদি আপনি না জেনে/ না বুঝে থাকেন তাহলে লজ্জার কোন কারণ নেই! আমি আজ আপনাদেরকে মাখনের মতো মোলায়েম করে বুঝাবো, যাতে আপনিও চার্টার্ড বিমানে চড়তে উৎসাহ পান এবং পরিকল্পনা করতে পারেন।
তবে বয়ান শুরু করার আগে একটু নানার বাড়ির গল্প করে নেই!
ছোট বেলায় নানার বাড়িতে গেলে দেখতাম নানি তার বাপের বাড়িতে যেত ছৈ- অলা নৌকা দিন চুক্তি ভাড়া করে। তখন গ্রামাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ বিশেষ ভালো ছিলনা, তাই বর্যাকালে নৌকাই ছিল ভরসা। মুদাফর গ্রামে আমার নানার বাড়ির কাছেই আব্দুল সাত্তার নামে একজন মৌসুমি মাঝি ছিল, উনি তার নৌকা দিয়ে বর্ষাকালে বাজারে গুদারা বাইতেন বা কেরায়া নৌকা চালাতেন।
যেহেতু ছয় সাত কিলোমিটার দূরে মান্দারতলী গ্রামে যেতে হবে তাই তার নৌকা সারাদিনের জন্য কখনো কখনো দুই দিনের জন্য ভাড়া করতেন। শর্ত ছিল যাত্রা পথে এই নৌকায় অন্য কাউকে উঠানো যাবেনা। যাত্রার দু’এক দিন আগেই তাকে বলে রাখা হতো।
সকালে রওয়ানা হওয়ার আগেই আমরা দুই ভাই সবার আগে নৌকার মাথায় গিয়ে জায়গা দখল করতাম। নানি, মা, মামা-খালারা সবাই মিলে পাঁচ ছয়জনের দল নিয়ে নৌকা ছুটে চলত। কখনো লগি বেয়ে, কখনো বৈঠা বেয়ে বিলের মাঝে দিয়ে ছুটে চলতো নৌকা। আমরা নৌকার মাথায় বসে পা ভিজিয়ে দিতাম আর মাঝি চিল্লাপাল্লা শুরু করে দিতেন। পা ভিজানোতে যে কি আনন্দ ছিল… হাত পেতে থাকতাম কখন একটা শাপলা খপ্ করে ধরে ফেলা যায়, শালুক ফুল তুলতাম, টলটলে স্বচ্ছ পানিতে পুঁটি মাছের দৌড় দেখতাম। শত শত রকমের বাহারি জলজ আগাছার ফাঁকে মাছ ধরার বাঁশের চাঁই গুলো দেখা যেত। কুমিরের মতো ঠোঁট ওয়ালা কাঁইক্কা মাছ গুলো দলবেঁধে লম্বা হয়ে ঠায় ভেসে থাকত। আমন ধানের চোখ জুড়ানো সবুজ পাতায় মৃদু ঢেউয়ের দোলা দিয়ে এগিয়ে চলতো নৌকা।
মাঝি কখনো কখনো সুযোগ বুঝে ধানের পাতা কয়েক মোটা কেটে নিয়ে পাটাতনের নিচে লুকিয়ে রাখতো। যদি বলতাম- অন্য মানুষের পাতা কাটেন কেন? মাঝি খেঁকিয়ে উঠে বলতো- এইটা তোগো খেত?
হলুদ ফুলে ছাওয়া ধইঞ্চা ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতাম শামুকের দল আটকে আছে গাছের সাথে, আর সাগুর দানার মতো একদলা ডিম থাকত কোন কোন টির গায়।
ক্লান্ত হয়ে পড়ন্ত বিকেলে আকাশ পানে মুখ করে শুয়ে দেখতাম খই ফোঁটা নীল আকাশ, আশেপাশে দেখতাম কই মাছের জাল পাততে ব্যস্ত কোন কিশোর, কেউবা আবার একঝাঁক চাঁই বোঝাই ডিঙি নৌকা নিয়ে ছুটে চলেছে তার পছন্দের বিলের পানে। এভাবেই এক সময় পৌঁছে যেতাম মায়ের নানার বাড়ি!
এবার বলি চার্টার্ড (Chartered) বিমান মানে কি?
সহজ কথায় বললে- কোন একটা উড়োজাহাজ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যক্তিগত ভাবে পুরোটাই ভাড়া করে কোন গন্তব্যে যাওয়া।
আপনি যখন উড়োজাহাজে টিকিট কেটে কোথায় যান, সেটাতেও আপনি ভাড়া দিয়ে যাচ্ছেন তবে ঐ উড়োজাহাজের নিয়ম কানুন আপনাকে চুপচাপ মেনে চলতে হবে। কিন্তু চার্টার্ড প্লেন চলবে আপনার হুকুমে!
আপনার দেয়া সময়ে আসবে, আপনার বলা টার্মিনালে আসবে, অপেক্ষা করবে, আপনি বললে আকাশে উড়বে, আপনার বলা গন্তব্যে বা দেশে পৌছাবে, তবে কতো গুলো শর্ত বা নিয়মকানুন মেনে।
ভাড়া বা খরচ কেমন হবে?
চার্টার্ড প্লেনে চড়তে হলে আপনার খরচ কেমন হবে সেটা কতোগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন-
★১) কোন ধরনের বিমান ভাড়া করবেন। ছোট জেট বিমান না বড় জেট? ২/৪/৬ নাকি ৮ আসনের? মডেল কোনটি- Cessna Citation Bravo, Embraer Phenom 300, Nextant 400XTi, নাকি Citation Mustang ইত্যাদি মডেল?
★২) যে দেশের/যে বিমান বন্দরে যাবেন সেখানে যেতে কতো ঘন্টা সময় (Flying hours) লাগবে? যেমন ঢাকা থেকে দুবাই যেতে আকাশে উড়ন্ত সময় লাগে সাড়ে ৫ ঘন্টা।এর সাথে যুক্ত হবে- সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে মোট কতো ঘন্টা লাগে সেটা। যেমন মোটামুটি সাধারণ মানের ৮ আসনের কোন সেসনা জেট বিমানের উড়ন্ত সময়ের জন্য লাগে ২ হাজার ডলার (১ লাখ ৭০ হাজার টাকা)। সেসনা সাইটেশন ব্রাভো তে প্রতি ঘন্টা -৭/৮ হাজার ডলার।
★৩) আনুষ্ঠানিকতার জন্যও ঘন্টা প্রতি ভাড়া। যেমন বিমানবন্দরে আপনার জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করলো, অবতরণের পর আপনাকে নামাতে কতক্ষণ লাগল (handling hour) ইত্যাদি।
★৪) বিমানবন্দরের পার্কি ফি, সকল প্রকার টেক্স এবং এমনকি কোন জরিমানা আসলে সেটাও আপনাকে বহন করতে হবে।
★৫) বিমানের তেলের (fuel) খরচ আপনাকে বহন করতে হবে।
★৬) দিন হিসেবে পাইলট এবং কেবিন ক্রু’দের বেতন আপনাকেই দিতে হবে। যত দিন আপনার সাথে চুক্তি ততো দিনের বেতন দিতে হবে। এক ঘন্টার চুক্তি হলেও এক দিনের বেতন দিতে হবে।
এক দিনের বেশি হলে ক্রু’দের হোটেলের ব্যবস্থা এবং খাওয়ার খরচ আপনাকেই বহন করতে হবে।
★৭) বিমানের ভিতরে আপনাকে যে খাবার পরিবেশন করা হবে সেটার খরচ তো অবশ্যই আপনার। অবশ্য কি কি খাদ্য বা অখাদ্য খাবেন সে গুলো আগেই ফরমায়েশ দিতে হবে, তারা সব ব্যবস্থা করে রাখবে!
(সংগৃহীত ছবিতে একটি চার আসন বিশিষ্ট Embraer Phenom 300 মডেলের জেট বিমান এবং ভিতরের দৃশ্য।)
….এবার আপনি বিমান ভাড়া করে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে পারেন! আমার কিন্তু চার্টার্ড নৌকা নিয়ে চলার অভিজ্ঞতা আছে!!!
কারা এসব চার্টার্ড প্লেন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়?
জি, ঠিক বলেছেন, যাদের অনেক টাকা তারাই!
আসলে তা নয়! যারা ধনীদের মধ্যে নিচু শ্রেণির তারা। কারণ যাদের অঢেল টাকা তারা ব্যক্তিগত বিমানই কিনে ফেলে, ভাড়া করার ঝামেলা শেষ। পৃথিবীর অনেক ব্যাক্তিরই নিজস্ব বিমান আছে, নেইমারের আছে জেট, বিল গেটসের আছে জেট, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আছে বিশাল বড় বোয়িং বিমান, যাতে মিটিং রুম আছে, খাট বিছানো আছে এবং গোসলখানাও আছে!
কারা ভাড়া করে এবং কখন ভাড়া করে এসব বিমান?
মনে করুন, আপনি বাংলাদেশের একজন প্রতাপশালী ধর্নাঢ্য বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। আপনি সবসময় টাকা রাখেন সুইস ব্যাংকে। এখন হঠাৎ কানাডায় আপনার ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবসায়িক কাজে ৫০ মিলিয়ন ডলার লাগবে দুই দিনের মধ্যেই! সুতরাং সুইস ব্যাংকে আপনাকে সশরীরে হাজির হতেই হবে। তখন কি করবেন, ফ্লাইটের টিকিট কেটে বসে থাকবেন নাকি একটা আস্ত বিমান ভাড়া করে উড়াল দিবেন?
আবার মনে করেন আপনি বিশিষ্ট শিল্পপতি, টাকার অভাব নাই। কিন্তু একটা আকাম করে পুলিশের খাতায় ‘ভুলবশত’ আপনার নাম উঠে গেছে। তখন আইফেল টাওয়ারের ছাদ থেকে কেউ একজন বুদ্ধি দিল- চার্টার্ড বিমানে করে বউ পোলাপান, কাজের বুয়া সব নিয়ে দুবাই চলে যাও, বাসায় পুলিশ গেলে মান ইজ্জত যাবে! তখন আপনি চলে গেলেন।
অবশ্য এমন লোক ছাড়াও মানুষ আছে যারা জরুরি প্রয়োজনে চার্টার্ড বিমান নিয়ে উড়াল দেয়। যেমন ২০০০ সালের দিকে আমেরিকা থেকে একজন আমেরিকান স্কুল ছাত্রী বাংলাদেশে ঢাকায় আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক টেনিস টুর্নামেন্টে খেলার ইচ্ছে প্রকাশ করে। সে বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশনে যোগাযোগ করে জানতে পারে নাম রেজিষ্ট্রেশন জন্য দিন মাত্র সময় বাকি আছে, অর্থাৎ আগামীকালই শেষ দিন।
মেয়েটি তার বাবাকে জানায় এবং তার বাবা তাকে চার্টার্ড বিমানে করে সঠিক সময়ে ঢাকায় এসে পৌঁছায়!
সংগৃহীত:এস কে সরকার,সুইজারল্যান্ড